সারা দেশে পবিত্র ঈদুল আজহায় বিপুলসংখ্যক পশু কোরবানি হয়। স্বভাবতই এখানে গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে কুরবানি-পরবর্তী শহর পরিষ্কারের বিষয়টি। পশু জবাইয়ের পর সঠিকভাবে তার বর্জ্য নিষ্কাশন না হওয়ার দরুণ শহরবাসীকেই পোহাতে হয় হাজারও ভোগান্তি। বিগত বছরগুলোতে মশাবাহিত রোগের উপদ্রব বাড়াতে পরিবেশজনিত এই জটিলতা আশঙ্কাজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া ধর্মীয় দিক থেকেও পরিবেশ আবর্জনামুক্ত রাখা প্রত্যেক কোরবানি পালনকারীর ঈমানি দায়িত্ব। তাই চলুন, পশু কোরবানির পর বাসা ও তার চারপাশ বর্জ্যমুক্ত রাখার কয়েকটি উপায় জেনে নেওয়া যাক। এই প্রতিবেদনে ঈদুল আজহায় পশু কোরবানির পর বর্জ্য অপসারণের ১০টি উপায় নিয়ে বলা হয়েছে।
একটি উপযুক্ত স্থান নির্বাচন
শহর বা গ্রাম নির্বিশেষে একটি নির্দিষ্ট এলাকার লোকজন আলাদাভাবে কোরবানি না দিয়ে কয়েকজন একসঙ্গে হয়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানে কোরবানি করা উত্তম। মূলত বসতবাড়ি থেকে যথাসম্ভব দূরে এমন একটি স্থান নির্বাচন করা উচিৎ, যেখান থেকে সহজেই পশুর বর্জ্য নিষ্কাশন করা যায়। এতে করে সিটি করপোরেশন কর্মীরা দ্রুত সময়ে বর্জ্য অপসারণের কাজ করতে পারবে। এ সময় খেয়াল রাখা উচিৎ, স্থানটি যেন চলাচলের রাস্তার উপরে না হয়। সাধারণত খোলামেলা পরিবেশে পশুর জীবাণু বেশি ছড়াতে পারে না। যারা সবার সঙ্গে একত্রিত হয়ে নির্দিষ্ট স্থানটিতে কোরবানি দিতে পারছেন না, তারা তাদের পশুর বর্জ্যগুলো নিজ দায়িত্বে কাছাকাছি ডাস্টবিনে ফেলে আসবেন।
পশুর রক্ত পরিষ্কার
পশু জবাইয়ের পর প্রথম কাজ হচ্ছে পশুর রক্ত সরিয়ে ফেলা। এর জন্য রক্ত সম্পূর্ণ ঝরে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অতঃপর পর্যাপ্ত পানি দিয়ে রক্ত ধুয়ে ফেলতে হবে। রক্ত অপসারণের জন্য কাছাকাছি কোনো ড্রেন ব্যবহারের সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন রক্তের সঙ্গে কোনো কঠিন বর্জ্য ড্রেনের মুখ বন্ধ করে না দেয়। তরল রক্ত দ্রুত সরিয়ে ফেলার পর রক্তের দাগ ও দুর্গন্ধ দূর করার জন্য জীবাণুনাশক ব্যবহার করতে হবে।
বর্জ্য খোলা স্থানে না রাখা
পশুর রক্তসহ অন্যান্য কঠিন ও তরল বর্জ্য উন্মুক্ত স্থানে রাখা ঠিক নয়। কেননা এতে রক্ত আর নাড়ি-ভুঁড়ি বাতাসের সংস্পর্শে এসে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দুর্গন্ধ ছড়ায়। এগুলো গর্ত করে ভেতরে রেখে মাটিচাপা দিতে হবে, অথবা সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িতে রেখে আসতে হবে। গাড়ি আসার আগ পর্যন্ত কোনো পলিব্যাগে ভরে কাছাকাছি কোনো ডাস্টবিনে যেয়ে ফেলে আসা যেতে পারে।
গর্ত করা
পশুর দেহের উচ্ছিষ্ট ও বর্জ্য নিষ্কাশনের উত্তম পন্থা হলো মাটিতে গর্ত করে পুঁতে ফেলা। অন্যথায় যেখানে-সেখানে ফেলে রাখলে তাতে পচন ধরে মারাত্মক দুর্গন্ধ ছড়াবে। এই পরিবেশ দূষণ পরবর্তীতে নানান রোগের কারণ হতে পারে। তাই কোরবানির আগেই নিকটবর্তী কোনো মাঠ বা পরিত্যক্ত জায়গায় ৩ থেকে ৪ ফুট গর্ত তৈরি করে রাখা উচিৎ। জবাই পর্ব শেষে পশুর শরীরের যাবতীয় উচ্ছিষ্ট এক করে সেই গর্তে ফেলে তার ওপর ব্লিচিং পাউডার, চুন, বা ফাম-৩০ নামক জীবাণুনাশক ছড়াতে হবে।
সবশেষে খড়কুটা ও কাঁটা জাতীয় কিছু ডালপালা দিয়ে আবৃত করে শক্ত করে মাটিচাপা দিতে হবে। এটি এক দিক থেকে বর্জ্য অপসারণের জন্য কার্যকর, অন্যদিকে জৈব সার হিসেবে শস্যক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য উপযোগী। মাটিচাপার দেয়ার পর তার ওপর কিছু মোটা তুষ ছিটিয়ে দিলে পরে কুকুর বা বিড়াল মাটি গর্ত করে ময়লা তুলতে পারবে না।
চামড়ার ব্যবস্থাপনা
কোরবানির পর যত দ্রুত সম্ভব পশুর চামড়া বিক্রি বা দান করে দিতে হবে। ক্রেতা হিসেবে এতিমখানা, মাদ্রাসা বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান চামড়াগুলো অবশ্যই কোথাও ম্তুব করে ফেলে রাখবেন না। কারণ এগুলো কিছুক্ষণের মধ্যেই দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পরিবেশ নষ্ট করে ফেলে।
ডাস্টবিনের যথাযথ ব্যবহার
পশু কোরবানির যাবতীয় কাজ শেষে উচ্ছিষ্ট ও ময়লা খুব দ্রুত সিটি করপোরেশনের বর্জ্যের গাড়িতে পৌছানো উচিৎ। ময়লা গাড়িতে ওঠানোর পরপরই পানি ও জীবাণুনাশক দিয়ে জবাই করার স্থান পরিষ্কারের কাজে লেগে যেতে হবে। গাড়ি আসতে দেরি হলে জমাকৃত আবর্জনা একটি বড় ব্যাগে ভরে ব্যাগের মুখ ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে। অতঃপর ব্যাগটি রেখে দিতে হবে ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট স্থানে, যেখান থেকে বর্জ্যের গাড়ি ময়লা নিয়ে যায়। পশুর যাবতীয় কঠিন বা তরল বর্জ্য কোনো ভাবেই পয়ঃনিষ্কাশন নালায় ফেলা যাবে না।
যারা ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে পশু জবাই দিয়ে থাকেন তাদের ভবনের জন্য একটি নির্দিষ্ট ডাস্টবিনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। পশুর কান, মাথার খুলি, হাড়, লেজ, ও পায়ের অবশিষ্টাংশ মোটা প্লাস্টিকের ব্যাগে জড়িয়ে নিতে হবে। অতঃপর এ সবকিছু একসঙ্গে করে রাখতে হবে সেই ডাস্টবিনে। বিষয়টি কোরবানির সময় ব্যবহৃত হোগলা, পাটি, কাপড় বা কাঠের গুঁড়ি এবং ন্যাকড়ার জন্যও প্রযোজ্য।
মাংস বাড়িতে নেওয়ার সময় সতর্কতা
মাংস প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার পর বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় মাংস ভর্তি বালতিতে কোনো রকম ফুটো থাকা চলবে না। কোরবানির স্থান থেকে বাড়ি দূরে হলে রাস্তা দিয়ে বয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে মাংসের রক্ত চুয়ে পড়ছে কিনা। প্রায় সময় দেখা যায়, সিঁড়ি বা লিফ্ট দিয়ে কাঁচা মাংস তোলার সময় সিঁড়ি বা লিফ্টে রক্তের দাগ লেগে আছে। শুধু তাই নয়, ঈদের ৩ দিন পর্যন্ত সিঁড়িঘর ও লিফট থেকে দুর্গন্ধ যায় না। তাই মাংস বহনকারি বালতিগুলো নিয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় সাবধান থাকা জরুরি।
লিফটের দুর্গন্ধের তীব্রতা কমানোর জন্য কুরবানির দিন লিফটের দরজা রাতের বেলা কিছুক্ষণ খোলা রাখা যায়। এতে বদ্ধ জায়গায় আটকে না থেকে দুর্গন্ধ বাইরে বেরিয়ে আসবে, আর কিছুটা হলেও দুর্গন্ধ কমবে।
ঘরের ভেতরকার পরিচ্ছন্নতা
মাংস ঘরে আনার আগেই ঘরের মেঝেতে প্লাস্টিকের বড় শীট বা পাটি বিছিয়ে রাখতে হবে। মাংস আনার পর তা কাটা, ওজন, ও বন্টনের জন্য এই পাটি ব্যবহার করতে হবে। কাজ শেষে পাটি উঠিয়ে পুরো মেঝে প্রথমে পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। এরপর হাল্কা গরম পানিতে ডিটারজেন্ট মিশিয়ে তা দিয়ে মেঝে মুছতে হবে।
মাংস কাটার সরঞ্জামাদি পরিষ্কার করা
মাংস রান্নার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলে এবার মাংস কাটার ছোট-বড় ছুড়ি ও বটি পরিষ্কার করার পালা। এগুলো নোংরা অবস্থায় রেখে দিলে অচিরেই নষ্ট হয়ে যাবে। ফলে পরের ঈদুল আজহায় এগুলো ব্যবহারের সময় পড়তে হবে বিড়ম্বনায়। তাই এগুলোও ভিম বার দিয়ে মেজে ও হাল্কা গরম পানিতে ধুয়ে গুছিয়ে তুলে রাখতে হবে।
দুর্গন্ধ দূরীকরণে জীবাণুনাশক ব্যবহার
কোরবানির পরবর্তী টানা কয়েকদিন ধরে যে বিষয়টি সবচেয়ে বিড়ম্বনার উদ্রেক করে তা হচ্ছে দুর্গন্ধ। বাড়ির ভেতরে-বাইরে এবং আঙ্গিনায় সর্বত্রে কাঁচা মাংসের গন্ধ ছড়িয়ে এক অসহনীয় পরিবেশের সৃষ্টি করে রাখে। এই দুর্গন্ধ পুরোপুরি দূর করা না গেলেও অনেকটা কমিয়ে আনা যায়। এর জন্য কোরবানির স্থানে পানি ঢেলে দেয়ার পর ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দিতে হবে। এতে রক্তের দাগ ও গন্ধ অনেকটাই কমে আসে।
বাড়ির ভেতরে এয়ার ফ্রেশনার দেয়া যেতে পারে। তবে এতে কাজ না হলে দারুচিনি, চিনি ও মাখনের মিশ্রণ ব্যবহার করা যায়। এগুলো একসঙ্গে ব্লেন্ড করার পর গরম করলে যে সুগন্ধি ছড়ায়, তাতে মাংসের দুর্গন্ধের তীব্রতা হাল্কা হয়ে আসে।
লেবু, লবঙ্গ, ও কমলার খোসা এই দুর্গন্ধ দূর করার ক্ষেত্রে বেশ কার্যকর। পানির সঙ্গে এই খাদ্যসামগ্রী ফুটানোর সময় হালকা এক সুগন্ধি তৈরি হয়, যা ঘরে অনেকক্ষণ যাবৎ থাকে। বেকিং সোডা ও সাদা ভিনেগারও ঘর থেকে কাঁচা মাংসের গন্ধ দূরীকরণে বেশ উপযোগী। তবে এগুলো ব্যবহারের সময় অবশ্যই এক্সস্ট ফ্যান ছাড়তে ভুলে যাওয়া চলবে না।